বাংলাদেশের সাহিত্য আকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র কবি মতিউর রহমান মল্লিক।।*****************************************
বাংলা সাহিত্য, কবিতা, গানে যে কজন কবি সাহিত্যিক তাদের নিজেদের পদচারণায় করেছেন হেরার আলোয় আলোকিত তাদের মধ্যে কবি মতিউর রহমান মল্লিক একজন। এই ধারা শুরু করেছিলেন ফররুখ আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম পরবর্তীতে কবি মতিউর রহমান মল্লিক সেই ধারার একজন যোগ্য নাবিক ছিলেন। যদিও প্রথম জীবনে কবি মতিউর রহমান মল্লিক গড্ডালিকা প্রবাহে প্রচলিত সাহিত্য নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছিলেন। কবিতা ছড়া গান লিখে ছিলেন যার উপজীব্য ছিল নারী পুরুষের প্রেমের কাহিনী নিয়ে। প্রেমের উপরে অনেক কবিতা ছড়া রয়েছে তার । সময়ের ব্যবধানে তিনি ইসলামী শিক্ষায় আলোকিত করেন নিজেকে এবং তার গাওয়া গান ইসলামী আদর্শের প্রতীক হয়ে দেখা দেয়। সেই প্রিয় কবি মতিউর রহমান মল্লিক সম্পর্কে আমরা কিছুটা জেনে নেই।
কবি জন্ম ও প্রাথমিক জীবন সম্পাদনা--
-------------------------------------------------------------
কবি মতিউর রহমান মল্লিক ১৯৫০ সালের ১লা মার্চ বাগেরহাট জেলার সদর উপজেলার বারুইপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মুন্সি কায়েম উদ্দিন মল্লিক স্থানীয় জারীগানের দলের জন্য গান লিখতেন।
মাতা আয়েশা বেগম। কবি ফররুখ আহমদ তৎকালীন রেডিও তে যে সাহিত্য আসর পরিচালনা করতেন সেই আসরে মল্লিকের বড় ভাই কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। পিতা মাতার সান্নিধ্যে থেকে তিনি গানের প্রাথমিক জীবন শুরু করেন। প্রাথমিক জীবনে রেডিওতে গান শুনে শুনে গান লেখা শুরু করেন। তখনকার তার প্রায় সকল গানই ছিল প্রেমের গান। পরবর্তীতে ইসলামী আদর্শে প্রভাবিত হয়ে ইসলামী ধারায় গান লেখা শুরু করেন।
শিক্ষা জীবনঃ-
--------------------
মল্লিক বারুইপাড়া সিদ্দীকিয়া সিনিয়র মাদ্রাসায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর বাগেরহাট পিসি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
কর্মজীবন সম্পাদনাঃ-
-----------------------------
কর্মজীবনে কবি মতিউর রহমান মল্লিক সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক, ‘বিপরীত উচ্চারণ’ সাহিত্য সংকলনও সম্পাদনা করেছেন, মাসিক কলম পত্রিকার সম্পাদক এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ সংস্কৃতি কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ সাহিত্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এক কুশলী শিল্পী কে হারিয়েছে।
মতিউর রহমান মল্লিক শৈশব থেকেই বিভিন্ন ধরনের সংগঠন গড়ে তুলতে থাকেন। ১৯৭৮ সালে ঢাকায় সমমনা সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিয়ে গড়ে তোলেন ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী। তারপর একে একে তার অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশের শহর, নগর, গ্রাম, গঞ্জ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যায়ল ও মাদরাসায় গড়ে ওঠে একই ধারার অসংখ্য সাংস্কৃতিক সংগঠন। শুধু তাই নয়, পশ্চিমবঙ্গ, আসামসহ বিশ্বের যেখানেই বাংলা ভাষাভাষী মুসলমান রয়েছে সেখানেই গড়ে উঠেছে একই ধারার বহু সাংস্কৃতিক সংগঠন। তার হাতের ছোঁয়া পেয়ে আজকে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ইসলামী জাগরণের সংগীত পরিবেশিত হচ্ছে।৷
সৃষ্টিশীল কবির সৃষ্টিকর্মঃ-
--------------------------------
কবি মতিউর রহমান মল্লিক ছিলেন একজন প্রচার বিমুখ মানুষ। প্রচার বিমুখ এ ব্যক্তিটি কাজ করেছেন মানুষের জন্য, মানবতার জন্য, বিশ্বাসের জন্য। ছোট বড় সবার জন্য লিখেছেন তিনি। তার লেখা অনেক কিন্তু কমই প্রকাশিত হয়েছে। ব্যক্তিগত সফলতার চেয়ে আদর্শিক সফলতার কথাই বেশি ভেবেছেন। তার ভক্ত শুভাকাঙ্খীদের আকুল আকতিতে কথা ও সুর নিয়ে সংস্কৃতিপ্রেমীদের মাঝে উৎসাহের কারণে কিছু কাজকে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করেছেন।-
নীষন্ন পাখির নীড়ে (কাব্যগ্রন্থ):আত্ম প্রকাশন
সুর-শিহরণ (ইসলামি গানের বই)
যত গান গেয়েছি (ইসলামি গানের সঙ্কলন)
ঝংকার (গানের বই)
আবর্তিত তৃণলতা (কাব্যগ্রন্থ) মোনালিসা প্রকাশন
তোমার ভাষার তীক্ষ্ন ছোরা (কাব্যগ্রন্থ) বাংলা সাহিত্য পরিষদ
অনবরত বৃক্ষের গান (কাব্যগ্রন্থ) মোনালিসা প্রকাশন
চিত্রল প্রজাপতি (কাব্যগ্রন্থ) প্রফেসর’স পাবলিকেশন্স
নির্বাচিত প্রবন্ধ (প্রবন্ধের বই)
রঙিন মেঘের পালকি (ছোটদের ছড়ার বই) জ্ঞান বিতরণী
প্রতীতি এক (ইসলামি গানের ক্যাসেট)
প্রতীতি দুই (ইসলামি গানের ক্যাসেট)
প্রাণের ভিতরে প্রাণ (গীতিকাব্য) উল্লেখযোগ্য।
অনুবাদক হিসেবে তার রয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। পাহাড়ি এক লড়াকু নামে আফগান মুজাহিদদের অমর কীর্তিকলাপ তার বিখ্যাত অনুবাদ উপন্যাস যা কিশোকণ্ঠের পাঠকরা মন উজার করে পড়তেন নিয়মিত। মহানায়ক (উপন্যাস) ছাড়াও হযরত আলী ও আল্লামা ইকবালের মতো বিশ্বখ্যাত মুসলিম কবিদের কবিতাও অনুবাদ করেছেন তিনি।
পুরস্কার ও স্বীকৃতিঃ-
---------------------------
কবি মতিউর রহমান মল্লিক বাংলা সাহিত্যে যে ভূমিকা রেখেছেন সেই ভূমিকার স্বীকৃতি আমার ব্যক্তিগত মত অনুযায়ী তিনি পাননি জানিনা কোনদিন এই জাতি তাকে সেই স্বীকৃতি দেবে কিনা। এরপরও কিছু সাহিত্য সংস্থা তাকে বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত করেছে
সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য তিনি বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। কবি মতিউর রহমানের প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও সম্মাননাঃ
সাহিত্য পুরস্কার : সবুজ-মিতালী সংঘ, বারুইপাড়া, বাগেরহাট। স্বর্ণপদক : জাতীয় সাহিত্য পরিষদ, ঢাকা।
সাহিত্য পদক : কলমসেনা সাহিত্য পুরস্কার, ঢাকা।
সাহিত্য পদক : লক্ষ্মীপুর সাহিত্য সংসদ।
সাহিত্য পদক : রাঙামাটি সাহিত্য পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম। সাহিত্য পদক : খানজাহান আলী শিল্পীগোষ্ঠী, বাগেরহাট। সাহিত্য পদক : সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদ।
সাহিত্য পুরস্কার : সমন্বিত সাংস্কৃতিক সংসদ, বাগেরহাট। প্যারিস সাহিত্য পুরস্কার : বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদ, ফ্রান্স। বায়তুশ শরফ সাহিত্য পুরস্কার : বায়তুশ শরফ আঞ্জুমানে ইত্তেহাদ বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম। ইসলামী সংস্কৃতি পুরস্কার : ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদ, চট্টগ্রাম। সাহিত্য পুরস্কার : বাংলা সাহিত্য পরিষদ, ফ্রান্স। কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার।
কবি মতিউর রহমান মল্লিক তার কর্ম তার ব্যাপ্তি সবই ছিল ইসলামের প্রচার-প্রসার কে নিয়ে নিশ্চয়ই তিনি মহান মাবুদের নিকট সম্মানিত হবেন আমরা সেই কামনা করি রাব্বুল ইজ্জাতের নিকট।
আমার দেখায় কবিঃ-
----------------------------
উনাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি আমরা দুই তিন বার। এর মধ্যে একবারে দীর্ঘ সময় ধরে অবস্থান করেছিলাম ২০০৬ সালে ঢাকার একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে।
আসহাবে রাসুলের জীবনী নিয়ে তিনি আমাদেরকে কথা শুনিয়ে ছিলেন। তার সেই কথা শুনে আমরা আসহাবে রাসূলের জীবনের গভীরে অবগাহন করেছিলাম। কবি মতিউর রহমান মল্লিকের বক্তব্য শুনে সেদিন অনেক কেঁদেছিলাম। সেই মরুপ্রান্তরে হারিয়ে গিয়েছিলাম তার কথার রেসে তার বক্তব্যের ভেতর দিয়ে অনুভব করেছিলাম হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু,হজরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু, হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু, হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু সহ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আসহাবদের জীবন কাহিনী এত সুন্দর করে তিনি আমাদের কাছে উপস্থাপন করেছিলেন আমরা বিমোহিত হয়ে সে কাহিনী শুনেছিলাম। বক্তব্যের এক ফাঁকে তিনি আমাদেরকে বললেন আজকে সকালে যখন আমি বের হচ্ছি তখন আমার বাসা থেকে বলা হয়েছিল বাসায় বাজার করে নিয়ে যাওয়ার জন্য দুপুরে মেহমান আসবে কিন্তু আমি কাজের চাপে সব ভুলে গেছি। এখন মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই গৃহিণী বাসায় গেলে আমাকে বকাঝকা করবেন, এত সাবলীলভাবে ভাবে নিজেকে উপস্থাপন করা, এত সাদাসিধে মানুষ আমার জীবনে আমি খুব কমই দেখেছি। সেই প্রিয় কবি মতিউর রহমান মল্লিক এখন আর নেই প্রকৃতির নিয়মেই তিনি চলে গেছেন মহান প্রভুর দরবারে।
যেভাবে চলে গেলেন এই গুণী শিল্পীঃ-
-------------------------------------------------
মতিউর রহমান মল্লিক ১১ আগস্ট ২০১০ সালে বুধবার রাতে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।তিনি দীর্ঘদিন ধরে কিডনী সহ শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর ই এবং আল্লাহর কাছে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে।।
মমিন উল্লাহ্ পাটওয়ারী।
লক্ষ্মীপুর।